অদৃশ্য সে শ্রম, অমূল্য তবু মূল্যহীন
সারা দিনের ক্লান্তি শেষে অফিসের দরজা ঠেলে ঘরে ফেরার পর এক গ্লাস পানি বা পরিপাটি করে রাখা স্যান্ডেল জোড়া পেতে সামান্য দেরি হলেই হয়তো আমাদের মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতি মুহূর্তে ঝরে পড়ে বিরক্তি। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখি, আমাদের এই স্বস্তির পৃথিবীটা কে সচল রাখে? আমরা সহজেই ভুলে যাই, ভোরের আলো ফোটার আগে কে আমাদের জন্য সকালের নাশতা আর দুপুরের খাবার তৈরি করে রেখেছিল। ভুলে যাই, সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে তার বিছানার চাদরটা টানটান করে গুছিয়ে রাখা, কিংবা সারা ঘরের এলোমেলো জিনিসপত্রকে একটি ছন্দে বেঁধে রাখার কাজটি নীরবে কে করে চলেছে।
এই কাজগুলো যেন তার দায়িত্বের অংশ, যার জন্য কোনো ধন্যবাদ বা স্বীকৃতি প্রয়োজন নেই। অদ্ভুত এক সামাজিক বৈপরীত্যের মধ্যে আমরা বাস করি। একজন নারী চাকরি করলে আমরা তাকে কর্মজীবী বলি, কিন্তু ঘরের কাজ করলে তার সেই শ্রমের কোনো নাম বা দাম থাকে না। পরিচিত মহলে আমরা অবলীলায় বলে ফেলি, ‘আমার স্ত্রী কিছু করে না, সে গৃহিণী’ কিংবা ‘আমার মা তো বাড়িতেই থাকেন’।
এই একটি বাক্যেই যেন তার সমস্ত সত্তা, তার অক্লান্ত পরিশ্রমকে শূন্যে মিলিয়ে দেওয়া হয়। এটি কেবল তাকে ছোট করা নয়, তার অস্তিত্ব এবং অবদানকে অস্বীকার করার সমান।
এর চেয়েও কঠিন বাস্তবতা হলো, নারী যখন বাড়ির বাইরেও কর্মজীবী হন, তখনও এই অদৃশ্য শ্রমের বোঝা তার কাঁধ থেকে নামে না। অফিসের কাজ শেষে তাকে প্রায়ই দ্বিগুণ গতিতে রান্না, ঘর গোছানো এবং সন্তানের দেখভালের যুদ্ধে নামতে হয়।
অথচ সমাজ প্রশ্ন তোলে না, বাবা বা স্বামী হিসেবে সেই দায়িত্বটুকু কেন ভাগ করে নেওয়া হলো না? নারীর এই ঘরোয়া শ্রমকে ‘স্বাভাবিক’ বা ‘জন্মগত দায়িত্ব’ ধরে নেওয়ার এই সম্মিলিত মানসিকতাই তাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অবদমিত করে রাখে।
আমাদের সমাজব্যবস্থা ঘরকন্না বা সন্তান লালন-পালনের এই বিশাল কর্মযজ্ঞকে ‘কাজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই নারাজ। অথচ এই ‘অদৃশ্য’ শ্রমই একটি পরিবারের, সমাজের এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতির সেই নীরব ভিত্তিপ্রস্তর, যার ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের সব অর্জন। যে নারী তার পুরোটা দিয়ে একটি ঘরকে আগলে রাখেন, তিনি কেবল ইট-সিমেন্টের একটি কাঠামোকে পরিচর্যা করেন না, তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলেন, পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার খেয়াল রাখেন। এই শ্রমের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়তো কঠিন, কিন্তু এর গুরুত্ব অপরিসীম।
পরেরবার ‘বউ কিছু করে না’ বলার আগে একবার ভাবুন, এই ‘কিছু না করা’র ওপর ভর করেই আপনার পৃথিবীটা টিকে আছে। তার এই ভালোবাসার শ্রমকে টাকার অঙ্কে মাপা সম্ভব নয়, কিন্তু তাকে প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের মানবিক দায়িত্ব। এই অদৃশ্য শ্রমের স্বীকৃতি আসুক আমাদের ঘর থেকে, আমাদের মন থেকে। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাই হোক এর সবচেয়ে বড় পারিশ্রমিক।
(কালের কণ্ঠ । ০৩ জুলাই ২০২৫)
মন্তব্যসমূহ