রাজনৈতিক স্যাটায়ারের নতুন অধ্যায়—ফারুকীর ‘৮৪০’
গল্প বলার মুনশিয়ানায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বরাবরই দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। এবার তিনি ফিরেছেন রাজনৈতিক বিদ্রুপে ভরা এক ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র ‘৮৪০’ নিয়ে। তার আগের আলোচিত নাটক ‘৪২০’- থেকে এক ধাপ উপরে উঠে ‘৮৪০’ যেন একটি সময়ের আয়না। এ সিনেমা দর্শকদের শুধু বিনোদিতই করবে না বরং ভাবতে বাধ্য করবে গভীরভাবে।
গল্পের ফ্রেমে বাংলাদেশের বাস্তবতা
‘৮৪০’ শুধু একটি সিনেমা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক মহাকাব্য। গল্পটি একটি জেলা শহরকে কেন্দ্র ধরে নির্মিত হলেও এর প্রতিটি দৃশ্য ও সংলাপে উঠে এসেছে বাংলাদেশের বিগত সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া ঘটনা। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার বাস্তবতা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সংলাপগুলো গল্পের গতি বাড়িয়েছে।
‘কল রেকর্ড ফাঁস করে দেব’ কিংবা ‘আমি শিগগিরই দেশে ফিরছি’—এমন সংলাপগুলো আজকের বাংলাদেশের রাজনীতির এক গভীর প্রতিচ্ছবি। এটি আওয়ামী আমলের ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে।
রাজনৈতিক স্যাটায়ারের গভীরতা
‘৮৪০’-এর অন্যতম শক্তিশালী দিক হলো এর সাহসী চিত্রায়ণ। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে সমাজের গভীর সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
সিনেমাটি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের রাজনীতির একটি সাধারণ চিত্রও উপস্থাপন করেছে। সিনেমায় দেখানো হয়েছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার অগ্রভাগে যা প্রদর্শিত হয়, বাস্তবতা তার থেকেও বেশি জটিল। এটি শুধু রাজনীতির ক্ষত চিহ্ন নয় বরং একটি সমাজের দিকনির্দেশনা। যারা এই সিনেমা দেখবেন, তারা নিজেদের ভুল-ত্রুটি অনুধাবন করতে বাধ্য হবেন।
দৃশ্যায়ন এবং পরিচালনা
রাজশাহী ও নওগাঁর স্থানীয় লোকেশনগুলোর সুনিপুণ ব্যবহার সিনেমাটিকে আরো উজ্জ্বল করেছে। ফারুকীর পরিচালনা দক্ষতায় প্রতিটি দৃশ্যই হয়ে উঠেছে অর্থবহ। চিত্রগ্রহণ এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দর্শকদের গল্পে আরো গভীরভাবে ডুবিয়ে দেয়। প্রতিটি ফ্রেম এতটাই যত্নে নির্মিত যে সিনেমাটি দর্শকদের মনোযোগ ধরে রাখে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
চরিত্রায়ণে জীবনের ছোঁয়া
মেয়র ডাবলু চরিত্রে নাসির উদ্দিন খানের অভিনয় ছিল চমৎকার। ক্ষমতালোভী, স্বার্থপর এবং ধূর্ত এক রাজনীতিবিদের চরিত্র তিনি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার প্রতিটি অভিব্যক্তি এবং সংলাপ বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়। ফজলুর রহমান বাবু, জায়েদ খান, বিজরী বরকতুল্লাহ, নাদের চৌধুরী, জাকিয়া বারী মম, শাহরিয়ার নাজিম জয় এবং মারজুক রাসেলের মতো দক্ষ অভিনয়শিল্পীরা তাদের অভিনয়ে চরিত্রগুলোকে প্রাণবন্ত করেছেন। রাজশাহী ও নওগাঁর স্থানীয় শিল্পীদের উপস্থিতিও সিনেমায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
শেষকথা
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘৮৪০’ একটি সময়ের দলিল। এটি শুধু রাজনৈতিক স্যাটায়ার নয় বরং বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির আয়না। যারা রাজনীতি বোঝেন কিংবা বোঝার চেষ্টা করেন, তাদের জন্য এটি অবশ্যই দেখা প্রয়োজন। সিনেমাটি প্রমাণ করে, গল্প বলার মধ্যে দিয়েও একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে বার্তা দেওয়া যায়।
(কালের কণ্ঠ । ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪)
মন্তব্যসমূহ