স্কুল বন্ধ, বাবা-মা অফিসে—আয়ানদের জন্য এই শহরটা বড় একা
স্কুল বন্ধ। অফিস খোলা। ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা এই জীবন যেন আয়ান-লাবিবাদের মতো অসংখ্য শিশুর জন্য এক করুণ পরিণতি। আজ সকালে বউ অফিসে চলে গেছে আগেভাগেই। আমি প্রস্তুত হচ্ছিলাম অফিসের জন্য, হঠাৎ লক্ষ করলাম আয়ান চুপচাপ বসে আছে। কাছে গিয়ে বসলাম, তবুও তার মুখে কোনো উজ্জ্বলতা নেই। একটু জড়িয়ে ধরতেই তার চোখ থেকে টলটল করে পানি গড়িয়ে পড়ল। বললাম, বাবা, একটু ড্রয়িং করো, খেলাধুলা করো... সে মাথা নাড়ল- যে করবে।
কিন্তু কথাগুলো যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। তার চোখে লেগে থাকা নিরানন্দের ছায়া আমার বুকের ভেতরটা ভারী করে দিল। এই শহরে বাবা-মা দুজনই যদি চাকরি করেন, তাহলে শিশুটির দিন কাটে একাকিত্বের নিঃশব্দ যন্ত্রণায়। স্কুল থাকলে দিনের একটা বড় অংশ কেটে যায় রুটিনের ছন্দে- স্কুলে যাওয়া, ফেরা, গোসল, খাওয়া।
কিন্তু স্কুল বন্ধ হলে সময় যেন থমকে যায়। দেয়ালের ঘড়িটা টিকটিক করে, আর শিশুটি অপেক্ষা করে কখন বাবা-মা ফিরবেন। লাবিবা একটু বড়, সে হয়তো নিজেকে সামলে নিতে শিখছে। কিন্তু আয়ান? তার মতো ছোট্ট শিশুর জন্য এই নির্জনতা যেন এক বিরাট শূন্যতা, যার মধ্যে হারিয়ে যায় খেলার সাথী, গল্পের সঙ্গী, আর মায়ের হাতের উষ্ণ স্পর্শ। শহরের কত ঘরেই না এই দৃশ্য।
সকালে বাবা-মা অফিসে চলে যান, শিশুটি রেখে আসেন একা, হয়তো কাজের মানুষের কাছে, নয়তো শুধুই চার দেয়ালের নীরব সাক্ষী হয়ে। সারাদিন সে হয়তো টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকে, কিংবা জানালা দিয়ে বাইরের পৃথিবীকে দেখে। খেলার সাথী নেই, গল্প শোনানোর কেউ নেই। বিকেল হলে হয়তো একটু বাইরে যাওয়া, কিন্তু সেই সঙ্গও যদি না জোটে? তখন তার দিন কাটে ফোনের স্ক্রিনে, বা হয়তো শুধুই ঘুমিয়ে পড়ার প্রতীক্ষায়।
এই যে নিঃসঙ্গতা, তা শুধু সময় কাটানোর সমস্যা নয়। এটি শিশুর মনে গভীর এক দাগ কাটে। সে শেখে একলা থাকতে, কিন্তু শেখে না কীভাবে ভাগ করে নিতে হয় আনন্দ। তার কল্পনার জগৎ সংকুচিত হয়ে আসে, কারণ সেখানে কথা বলার কেউ নেই। বাবা-মা ফিরে এসে যখন তাকে সময় দেন, তখনও সেই সময়ের ছায়ায় থাকে অফিসের ক্লান্তি, বাড়ির কাজের চাপ। শিশুটি বুঝতে পারে না কেন তার মা-বাবার চোখে সব সময় একটা অবসাদ ভাসে।
আমি অফিসে যাওয়ার আগে আয়ানের দিকে তাকালাম। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, বাইরে তাকিয়ে। হয়তো স্কুলের বন্ধুদের কথা ভাবছে, কিংবা সেই মুহূর্তগুলোর কথা যখন আমরা সবাই একসাথে থাকি। কিন্তু আজ তাকে পার করতে হবে দীর্ঘ এক দিন। আমার বুকটা চেপে ধরে। এই শহরের কত শিশুই না এমন দিন পার করে? যাদের বাবা-মা সংসার চালানোর জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেন, কিন্তু সেই সংসারের ছোট্ট সদস্যটি কি পায় তার প্রাপ্য উষ্ণতা?
আমরা কি পারি না কিছুটা হলেও এই অবস্থা বদলাতে? হয়তো অফিসের সময়টা একটু নমনীয় করা যায়, হয়তো কাজের ফাঁকে ফোন করে একটা গল্প বলা যায়, কিংবা সপ্তাহে একটা দিন হলেও পুরোপুরি তাদের জন্য রাখা যায়। কারণ, আজ আয়ানের চোখের জল শুধু তার একার নয়। এটি এই সমাজের সব কর্মজীবী বাবা-মায়ের হৃদয়ে লাগা এক অদৃশ্য ক্ষত, যা আমরা প্রতিদিন উপেক্ষা করে যাই।
শিশুরা বড় হয় মায়ের স্পর্শে, বাবার গল্পে, পরিবারের উষ্ণতায়। কিন্তু আমরা যদি তাদের শুধু সময় দিতে না পারি, তাহলে এই বড় হওয়াটা কতটা সুন্দর হয়? শহরের এই নিঃসঙ্গ শিশুদের হাহাকার কি আমরা কখনোই শুনব না?
(কালের কণ্ঠ । ১৭ জুন ২০২৫)
মন্তব্যসমূহ