রেললাইন যেন মৃত্যুর ফাঁদ না হয়


চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে রেললাইনে বসে গল্প করছিলেন তিন বন্ধু। কথার ফাঁকে কখন যে ট্রেনটা ধেয়ে এলো, কেউ বুঝে ওঠার আগেই তাদের জীবন থেমে গেল। এই মর্মান্তিক ঘটনা নতুন নয়। কিছুদিন আগে ঢাকার কুড়িলে ট্রেনের ভিডিও করতে গিয়ে এক তরুণ প্রাণ হারালেন।

একদিকে মনোযোগ, অন্যদিকে অসতর্কতা-এই দুইয়ের ফাঁদে পড়ে রেললাইনে কাটা পড়ার ঘটনা যেন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রেললাইন নিয়ে আমাদের অনেকের মাঝেই একধরনের উদাসীনতা কাজ করে। কেউ ভাবেন, ট্রেন তো শব্দ করেই আসে, আগেভাগেই দেখে সরে যাব। কেউ ভাবেন, মোবাইলে একটু কথা বলি বা ছবি তুলি, এতে এমন কী।

কিন্তু সেই 'এমন কী'-তেই থেমে যাচ্ছে তরতাজা জীবন। এর আগে হবিগঞ্জে এক চা–শ্রমিক মোবাইলে কথা বলছিলেন, ট্রেন এসে থামিয়ে দিল সব কথা। বগুড়ায় এক ওয়েম্যান, যিনি লাইনেরই কাজ করতেন, তিনিও ট্রেনের নিচে প্রাণ হারালেন। লালমনিরহাটে চার দিনমজুর গল্প করছিলেন রেললাইনের পাশে-আর তারা আজ কেউ নেই। এমন অনেক ঘটনাই রয়েছে।

সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, এসব মৃত্যু অনেকটা প্রতিরোধযোগ্য ছিল। রেললাইন কোনো বেঞ্চ নয়, ওটা বসার জায়গা না। রেললাইন কোনো হাঁটার পথ নয়, ওটা জীবন নিয়ে খেলার জায়গা না। অথচ প্রতিদিন আমরা দেখছি কেউ রেললাইন ধরে হাঁটছে, কেউ বসে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ আবার কানে ইয়ারফোন গুঁজে উদাসভাবে সামনে হাঁটছে। আর যখন ট্রেন আসে, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।

রেল চলাচলের নিরাপত্তা রক্ষায় দেশের প্রচলিত আইনও রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুট পর্যন্ত এলাকা সবসময়ই ১৪৪ ধারা জারিকৃত এলাকা হিসেবে গণ্য হয়। সেখানে কারো অবস্থান বেআইনি। আইন অমান্য করলে গ্রেফতারও করা যায়। এমনকি গবাদি পশু ওই এলাকায় প্রবেশ করলে সেটাও জব্দ করে বিক্রির বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আইন শুধু কাগজেই থেকে যাচ্ছে। বাস্তবতা হলো, মানুষ এই আইন জানেও না, মানেও না।

আর এই অমান্যতার ফল হলো মৃত্যু। একটা ছবি তুলতে গিয়ে, একটা কল ধরতে গিয়ে, কিছু সময় গল্প করতে গিয়ে কত জীবন অকালে থেমে যাচ্ছে! পরিবার হারাচ্ছে আপনজন, মা হারাচ্ছে ছেলে, বন্ধুরা হারাচ্ছে প্রিয় মুখ-এই ক্ষতি কোনোভাবে পূরণ হওয়ার নয়।

সমাধান কী? প্রথমত, আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। সচেতন হতে হবে ব্যক্তি পর্যায় থেকেই। রেললাইন আমাদের চলার পথ নয়-এই সহজ কথাটা নিজে বুঝতে হবে, অন্যকেও বোঝাতে হবে। স্কুল, কলেজ, পরিবার-সব জায়গায় এ নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হতে হবে, প্রচার বাড়াতে হবে, প্রয়োগ করতে হবে প্রচলিত আইন।

আমরা যেন রেললাইনকে গল্পের স্থান না ভাবি। ওটা যন্ত্রচালিত মৃত্যুর পথ-সচেতন থাকলেই এড়িয়ে চলা যায়। একটু সতর্কতা, একটু দায়িত্ববোধ-এই দুটোই পারে রেললাইনকে মৃত্যুর ফাঁদ থেকে নিরাপদ পথে রূপ দিতে। জীবন একটাই, তাকে হেলায় শেষ করার মতো ভুল আর যেন কেউ না করে।

(কালের কণ্ঠ । ১৯ জুন ২০২৫)

মন্তব্যসমূহ