শিষ্টাচার শেখানো মানে ভবিষ্যতের জন্য আলো জ্বালিয়ে যাওয়া
শিষ্টাচার কেবল কিছু নির্দিষ্ট আচরণবিধি বা সামাজিক নিয়মের তালিকা নয়-এটি মানুষের ভিতরকার সুকুমারবৃত্তির প্রকাশ। ছোট ছোট অভ্যাস ও আচরণের মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে একজন মানুষের প্রকৃত চরিত্র, তার মূল্যবোধ, তার মানবিকতা। সন্তানকে নৈতিকতা ও শিষ্টাচার শেখানোর অর্থ তাকে শুধু সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলা নয়-বরং তাকে গড়ে তোলা একজন সংবেদনশীল, দায়িত্ববোধসম্পন্ন, বিবেকবান মানুষ হিসেবে।
প্রতিদিনের জীবনের সাধারণ কিছু দৃশ্য- যেমন, একটি শিশু কিউ ধরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, শব্দ না করে বাসায় কথা বলছে, গালাগালি না করে ভদ্র ভাষায় নিজের অবস্থান তুলে ধরছে-এসবই একটি উন্নত মানসিকতার প্রতিচ্ছবি।
যখন সে কিউতে দাঁড়িয়ে নিজের পালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে শেখে, তখন সে কেবল শৃঙ্খলাই রপ্ত করে না, বরং অন্যদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা পায়। শব্দদূষণ না করার অভ্যাস তার মধ্যে তৈরি করে সচেতনতা-এই পৃথিবীতে সে একা নয়, তার চারপাশেও মানুষ আছে, যাদের প্রশান্তি ও স্বস্তির দায়িত্ব সে কিছুটা হলেও বহন করে।
বড়দের বসতে দিয়ে সে কেবল বয়সের মর্যাদাই দেয় না, বরং সামাজিক সৌজন্য ও শ্রদ্ধাবোধের চর্চাও করে। গালাগালি বা অহেতুক তর্ক থেকে দূরে থাকার শিক্ষা তার মধ্যে তৈরি করে ধৈর্য্য, সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি।
আর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অসচেতনভাবে ধূমপান না করার মতো আচরণ থেকে সে বুঝে নিতে শেখে-ব্যক্তিগত অভ্যাসও যেন অন্যের জন্য অস্বস্তির কারণ না হয়। এমনকি রাস্তায় থুথু না ফেলা, খাবারের মোড়ক যেখানে-সেখানে না ছোড়া-এসব ছোট ছোট আচরণই গড়ে তোলে একজন সত্যিকারের সুশিক্ষিত নাগরিক।
এই ছোট ছোট শিখনগুলো এক সময় গিয়ে দাঁড়ায় বড় এক চেতনার সামনে-একজন মানুষ কেমন হবে, তার ভিত কেমন হবে, তা গড়ে ওঠে এমনই শৈশব অভ্যাসে। শিষ্টাচার মানুষকে শুধু বাহ্যিকভাবে মার্জিত করে তোলে না, ভিতর থেকেও তাকে করে তোলে আলোকিত।
সভ্যতার গোড়াপত্তন যেমন হয়েছিল এই শিষ্টাচারের ভিতর দিয়ে, সভ্যতার স্থায়িত্বও টিকে থাকে এর মাধ্যমেই। একটি হাসি, একটি ‘ধন্যবাদ’, কিংবা অল্প একটু সহানুভূতি-এসবই মানুষে মানুষে তৈরি করে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সম্প্রীতির বন্ধন।
তবে এই শিক্ষাগুলো কেবল মুখে বলে দিলে হবে না। শিশুরা ‘বলা’ থেকে নয়, ‘দেখা’ থেকে শেখে। তারা বাবা-মায়ের প্রতিটি আচরণ নীরবে গ্রহণ করে, অনুকরণ করে। তাই শিষ্টাচার শেখানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নিজের আচরণে তার প্রতিফলন ঘটানো। যখন তারা দেখে, বাবা ট্রাফিক সিগনাল মেনে রাস্তা পার হচ্ছেন, মা বাসায় গৃহকর্মীকে সম্মান দিয়ে কথা বলছেন, কিংবা কেউ ব্যথা পেলে তার পাশে দাঁড়াচ্ছেন-সেসব দৃশ্যই হয়ে ওঠে তাদের জীবনের আদর্শ।
পরিবারই শিশুর প্রথম বিদ্যালয়, আর বাবা-মা হচ্ছেন সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এখানে যে বীজ রোপিত হয়, তা যদি যত্নে পরিচর্যা করা যায়, তবে তা একদিন অঙ্কুরিত হয়ে সমাজে ছায়া ও ফল দেবে। এই ছোট ছোট বীজ থেকেই গড়ে উঠবে এমন এক ভবিষ্যৎ, যেখানে মানুষ শুধু নিজের জন্য নয়-পাশের মানুষের জন্যও ভাববে, ভালোবাসবে, সহানুভূতিশীল হবে।
সন্তানকে শিষ্টাচার শেখানো মানে শুধু একজন ভালো মানুষ গড়ার চেষ্টা নয়-এটি একটি সভ্য সমাজ, একটি আলোকিত পৃথিবী গড়ার জন্যই একেকটি আলো জ্বালিয়ে যাওয়া।
(কালের কণ্ঠ । ২৮ জুন ২০২৫)
মন্তব্যসমূহ