এই মেঘলা দিনের দুঃখগাথা


সূর্য তখন মাথার ওপরে। আকাশে মেঘ থাকলেও সূর্য তীব্রভাবে উঁকি দিচ্ছে। আমি ইছামতীর বুকের ওপর ব্রিজে দাঁড়িয়ে আখ চিবোচ্ছি। আশেপাশে অনেক মানুষ—পুরো ব্রিজের রেলিং ভরে গেছে দর্শকে। নদীতে সিনেমার শুটিং হবে বলে আগেই একটি নৌকা আনা হয়েছে। তবে কলা-কুশলীরা তখনো এসে পৌঁছাননি।

অনেকক্ষণ পর একটি মাইক্রোবাস ও একটি পিকআপ এসে থামল উথলী বাসস্ট্যান্ডে। তখন সূর্য মাথার ওপর থেকে খানিকটা সরে গেছে, আর আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মাইক্রোবাস থেকে কয়েকজন নামলেন—সেদিনই প্রথম দেখি তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিন মাসুদকে। তাদের সঙ্গে ছিল সাদা পাঞ্জাবি পরা এক কিশোর। 

পিকআপ থেকে একটি নৌকার ছই নামানো হলো। আমি বেশ কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু দেখা গেল—যে নৌকাটি আগে থেকে ঠিক করা ছিল, তার ওপর এই ছই বসানো সম্ভব হচ্ছে না। নৌকাটি তুলনামূলক বড় ছিল। লোকজন দ্রুত নৌকার মূল ছই খুলে ফেলল, তবুও নতুন ছইটি লাগানো যাচ্ছিল না। ক্যাথরিন মাসুদ বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন, তারেক মাসুদের মুখেও উদ্বেগ।

উথলী ব্রিজের দক্ষিণ পাশে শুটিং হবে, তাই সবাই সেদিকেই ভিড় করেছে। আমি উত্তর পাশে ডাকবাংলোর ঘাটে বাঁধা একটি নৌকা দেখতে পেলাম—মনে হলো, তাদের আনা ছইটি তাতে ঠিকঠাক লাগবে। এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমি একটা নৌকা এনে দিচ্ছি। তারেক মাসুদ আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন।

এরপর ব্রিজের কাছে ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ। সেই কিশোর ও আরেকজন লোক নৌকায় উঠলেন। মাঝিকে বলা হলো কিছু দূর নৌকা বাইয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু মাঝি যাচ্ছে তো যাচ্ছেই! অবশেষে ফের ডেকে আনা হলো। প্রায় ত্রিশ মিনিট শুটিং চলল নদীতে। শুটিং কীভাবে হলো—মানুষজন কিছুই বুঝতে পারল না। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে ব্রিজের ভিড় কমে এলো, আকাশ ঘন মেঘে ঢেকে গেল।

তারপর তারা অন্যত্র যাবেন। যাওয়ার আগে, নৌকাটি বুঝিয়ে দেওয়ার সময় তারেক মাসুদ হেসে বললেন—'ডাব খাওয়াতে পারবে?' সঙ্গে সঙ্গে আমি বাসস্ট্যান্ড থেকে এলাকার এক ডাবওয়ালা চাচাকে ডেকে আনলাম। তিনি সবাইকে ডাব কেটে খাওয়ালেন। কয়েক মিনিটের পরিচয়েই তিনি আমাকে এতটা আপন করে নিয়েছিলেন যে, নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছিলেন।

ব্যস, এটাই প্রথম পরিচয়।

দ্বিতীয় ও শেষবার তাকে দেখি ২০১১ সালের ১৩ আগস্টের সেই মেঘলা দিনে—ঘিওরের জোকা এলাকায়। কিন্তু সেদিনের দৃশ্য সহ্য করা অসম্ভব ছিল। রাস্তার কালো পিচের ওপর উদ্ধারকারীরা তাকে টেনে এনে শুইয়ে রেখেছে। সঙ্গে আরো কয়েকজনও পড়ে আছেন। বৃষ্টিতে তাদের রক্ত কালো পিচের ওপর বয়ে যাচ্ছে—দৃশ্যটা অমানবিক!

মনে হচ্ছিল, যদি একবার ছুঁয়ে দেখতে পারতাম তাকে! হয়তো বলবেন—'যাও একটা ছাতা নিয়ে আসো!' কিন্তু আমি বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কালো পিচে কোনটা কার রক্ত—চেনা যাচ্ছিল না। বুকটা ভার হয়ে আসছিল, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এক সাংবাদিক এসে আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিলেন। সেদিন তাকে আর ছুঁয়ে দেখা হয়নি।

তারেক মাসুদের কেন যেন মানিকগঞ্জের শিবালয়ের প্রতি আলাদা টান ছিল। প্রথম পরিচয় হয়েছিল যখন তিনি মাটির ময়না সিনেমার শুটিং করতে এসেছিলেন। শেষবার এসেছিলেন কাগজের ফুল–এর জন্য। কে জানত, এটাই হবে তার জীবনের শেষ আসা! তিনি মানিকগঞ্জকে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন এখানকার মানুষকেও। হয়তো সেজন্যই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন মানিকগঞ্জেই।

এই লেখাটা লিখতে গিয়ে বারবার মনে পড়ছিল প্রায় চব্বিশ বছর আগের সেই মেঘলা দিনের কথা—ইছামতীর তীরে ঘটে যাওয়া মুহূর্তগুলোর কথা! কয়েক মিনিটের পরিচয়ে তিনি আমাকে আমার পুরো নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে নতুন নামে ডেকেছিলেন। মেঘলা দিন ফিরলেই বুক ভার হয়ে আসে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কালো পিচে গড়িয়ে যাওয়া লাল রক্তের স্রোত।

আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

(কালের কণ্ঠ । ১৩ আগস্ট ২০২৫)

মন্তব্যসমূহ