ঋণ, ক্ষুধা ও এক করুণ বিদায়
রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বামনশিকড় গ্রাম। শান্ত এই গ্রামটি এখন শোকের ভারে নুয়ে আছে। গ্রামের এক বাড়িতে একই পরিবারের চারজনের মৃত্যুর ঘটনা এই শোকের কারণ। ওই বাড়িতে গতকাল সকালে এই চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। একই সঙ্গে পাওয়া গেছে একটি চিরকুট।
চিরকুটের বর্ণনা অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে, ঋণের বোঝা বইতে না পেরে আর খাওয়ার অভাবের তাড়নায় মিনারুল ইসলাম নামের এক কৃষক নিজের স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর আত্মহত্যা করেন। মিনারুলের স্ত্রী মনিরা বেগম, মেয়ে মিথিলা খাতুন ও ছেলে মাহিম। মিনারুলের একাধিক স্বজন বলেছেন, চিরকুটের ওই লেখা তাঁর।
মিনারুল লিখেছেন জীবনের শেষ কথাগুলো। এতে ফুটে উঠেছে অভাবের তাড়না আর ঋণের চাপে বিধ্বস্ত একটি মানুষের চূড়ান্ত মানসিক অবস্থা।
সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমি নিজ হাতে সবাইকে মারলাম। এই কারণে যে আমি যদি মরে যাই, তাহলে আমার ছেলে-মেয়ে কার আশায় বেঁচে থাকবে? কষ্ট আর দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবে না। আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। তাই আমরা বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম সেই ভালো।’
শব্দগুলো পড়লে মনে হয় এগুলো নিছক কিছু বাক্য। কিন্তু এর ভেতরে রযেছে অসহায়ত্ব, ক্ষুুধা, অপমান, গ্লানি আর দিনের পর দিন বুকের ভেতর চেপে রাখা কান্না। একজন বাবা, যিনি পৃথিবীর সব কষ্ট সহ্য করতে পারেন নিজের জন্য, কিন্তু সন্তানদের জন্য পারেন না। তিনি বিশ্বাস করেছেন, জীবিত থাকলে সন্তানরা শুধু কষ্ট পাবে আর অপমানিত হবে।
চিরকুটে আরো লেখা ছিল, ‘কারো কাছে কিছুই চাইতে হবে না। আমার জন্য কাউকে কারো কাছে ছোট হতে হবে না। আমার জন্য আমার বাবা অনেক লোকের কাছে ছোট হয়েছে। আর হতে হবে না। চিরদিনের জন্য চলে গেলাম। আমি চাই সবাই ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।’
এখানে ফুটে উঠেছে তাঁর হৃদয়ের সবচেয়ে গভীর ক্ষত চিহ্নটি। বারবার অপমানিত হওয়া, মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে গিয়ে নিজের কিংবা পরিবারের সম্মান হারানো, সব তাকে ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তিনি চাননি সন্তানরা এই পথ দিয়ে হাঁটুক, চাননি পরিবারকে আর কারো সামনে ছোট হতে হোক। তাই তিনি এমন এক সিদ্ধান্ত নিলেন, যা শোনার পরও বিশ্বাস করা কঠিন।
মৃত্যুর আগের সেই মুহূর্তে হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, এই পথেই মুক্তি, এই পথেই শেষ হবে অপমান আর ক্ষুুধার লড়াই। কিন্তু সেই মুক্তির জন্য তিনি নিজের প্রিয় সন্তানদের জন্যও বেছে নিলেন নির্মম পথ। এটি শুধু এক পিতার নয়, এক স্বামীর নয়, এটি আমাদের সমাজেরও ব্যর্থতা। কারণ আমরা কেউ তাঁর কান্না শুনতে পাইনি, কেউ তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়াইনি।
এ ঘটনা শুধু একটি গ্রামের নয়, এটি গোটা সমাজের জন্য এক সতর্কবার্তা। আমাদের চারপাশে হয়তো আরো অনেক মিনারুল আছেন, যাঁরা নীরবে লড়ছেন ক্ষুধা, ঋণ আর অপমানের সঙ্গে। কিন্তু তাঁরা কথা বলছেন না। কারণ বললেও হয়তো শোনা হবে না অথবা শোনা হলেও বোঝা হবে না।
মিনারুলের এই শেষ চিঠি যেন আমাদের চোখ খুলে দেয়। যাতে আমরা বুঝতে পারি, ক্ষুুধা শুধু পেটে লাগে না, লাগে মনেও। আর অপমান শুধু মুহূর্তের জন্য কষ্ট দেয় না, ধীরে ধীরে মানুষকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়। হয়তো সময় থাকতে যদি কেউ তার পাশে দাঁড়াত, যদি কারো সঙ্গে তিনি নিজের দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ পেতেন, তাহলে আজ গল্পটা ভিন্ন হতে পারত।
এই মৃত্যু যেন আরেকটি পরিসংখ্যান হয়ে না থাকে। যেন আমরা মানুষ হয়ে মানুষের কষ্ট বুঝতে শিখি, সময় থাকতে তাদের দিকে হাত বাড়াই। কারণ জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই। কিন্তু সেই জীবন যদি হয়ে ওঠে অসহ্য, তাহলে হয়তো তার মূল্যই থাকে না কারো কাছে। আর তখনই লেখা হয় এমন চিঠি, যা পড়তে গিয়েও বুকের ভেতর হাহাকার জমে ওঠে।
মিনারুলের এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, অর্থনৈতিক সংকট এবং দারিদ্র্য কতটা ভয়ংকর হতে পারে। এটি শুধু একটি পরিবারের সমাপ্তি নয়, এটি আমাদের সমাজের সেই অন্ধকার দিক, যা আমরা প্রায়ই এড়িয়ে চলি। এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজে এমন আরো অনেক মিনারুল আছেন, যাঁরা নীরবে কষ্ট করছেন। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের যন্ত্রণা বোঝার চেষ্টা করা এবং একটি মানবিক সমাজ গড়ে তোলা আমাদের সবার দায়িত্ব।
অভাব-অনটন ও ঋণের চাপে আত্মহত্যা—এটাই নতুন নয়। তিন দিন আগেও কুমিল্লার বুড়িচংয়ে নিজ ঘরে মা ও মেয়ে আত্মহত্যা করেন। ২ জুন নাটোরের লালপুরে স্বামী-স্ত্রীর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ২৯ জুন কক্সবাজারের চকরিয়ায় এনজিওর কাছ থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপে এক যুবক গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
গত বছর ২৫ ফেব্রুয়ারিতে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে দুই সন্তানকে হত্যার পর এক মা আত্মহত্যা করেছিলেন।
শুধু এই কয়েকটি ঘটনাই নয়, প্রতিবছরই ঋণের চাপ সইতে না পেরে মানুষ নিজেই বা পরিবারকে নিয়ে জীবন শেষ করছে। প্রতিটি ঘটনা আমাদের সতর্কবার্তা। ক্ষুুধা, ঋণ ও মানসিক চাপ কখনোই এককভাবে মাপা যায় না; এগুলো সমাজের সর্বস্তরে ধীরে ধীরে মানুষকে ভেঙে দেয়। তাই আমাদের দায়িত্ব, মানবিকতা বজায় রেখে যারা এই সংকটে আছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং সমাধানের পথ তৈরি করা।
(কালের কণ্ঠ । ১৬ আগস্ট ২০২৫)
মন্তব্যসমূহ