কিশোরদের বখে যাওয়া—বাবা হিসেবে আমার উদ্বেগ
রাত সাড়ে ৯টা। পরিবার নিয়ে বাইরে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে আমি ও আমার ছয় বছরের ছেলে এক রিকশায়, আর পেছনের রিকশায় সেভেনেপড়ুয়া মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে। বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি এমন সময় হঠাৎ দেখি, দুটি সাইকেলে চেপে আসা দুই কিশোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একের পর এক অশালীন শব্দ ছুড়ে দিচ্ছে।
প্রথমে কিছু না বলে সহ্য করলাম, কিন্তু তারা সামনে এসে আরেকটু বাড়াবাড়ি করতেই ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের বাসা কোথায়? সেই প্রশ্ন করতেই যেন আগুনে ঘি পড়ল। মুহূর্তেই আরো কয়েকজন কিশোর সাইকেল নিয়ে ছুটে এলো। ৪-৫ জন মিলে আমাদের রিকশা ঘিরে ধরল। আমি তখন স্ত্রী-সন্তানদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি কিভাবে পরিস্থিতি সামলাব।
অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে, ধৈর্য ধরে কথাবার্তা বলে কোনোভাবে নিজেদের নিরাপদে সরিয়ে আনি। কিন্তু সারা রাত ঘুম আসেনি। বারবার ভাবছিলাম, এদের এত সাহস কেন? কারা এদের সাহস জোগায়?
রাত সাড়ে ১০টা। বউয়ের মোবাইলে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন। ওপাশে এক কিশোর বলছে, এক প্যাকেট কাচ্চি আর দুটি ২৫০ এমএলের কোক এসেছে, নিচে নামতে হবে। স্ত্রীর পাশে বসে আছি, সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন করলাম, কে অর্ডার করেছে? ওপাশ থেকে মেয়ের নাম বলা হলো। মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানায়, এমন কিছুই অর্ডার করেনি।
ঈদের রাতে প্রায় সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকে, বিষয়টা সন্দেহজনক লাগল। সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন দিয়ে নম্বরটি ট্রেস করতে বললাম। তারপর নিজেই নম্বরে কল দিলাম। কয়েকবার বাজানোর পর ফোন ধরে এক মেয়ে। জানায়, এটি তার ছোট ভাইয়ের কাজ। দুঃখও প্রকাশ করল।
প্রথম ঘটনা কয়েক মাস আগের, দ্বিতীয়টি গতকালের। কিন্তু দুটো ঘটনার পর থেকেই বুকের ভেতর একটা অস্বস্তি চেপে বসে আছে। আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। মেয়ে বড় হচ্ছে, আর বাবা হিসেবে টেনশন বাড়ছে। ছেলে এখন ছোট, কিন্তু সেও তো একদিন বড় হবে। সে কি এমনই হবে? নাকি আমরা পারিবারিকভাবে কিছুটা হলেও দায় এড়িয়ে যাচ্ছি?
প্রতিদিনই খবরের কাগজে পড়ি, কোনো না কোনো জায়গায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। এরা কারা? কোথা থেকে আসে? কেন এমন হয়ে উঠছে? কেউ কি কখনো ভেবে দেখে, এসব ছেলের পরিবার কোথায়? মা-বাবা কি জানেন তাদের সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে? তারা কি কখনো খেয়াল রাখেন সন্তানের রাত কাটে কোথায়? যদি দেখেন, তাহলে কেন প্রতিবেশী বা পথচারীদের এভাবে উত্ত্যক্ত করবে?
আমার মনে হয়, আমাদের সমাজে কিশোরদের এই বখে যাওয়ার পেছনে বড় দায়টা পরিবার ও অভিভাবকদের। শুধু খাবার-পোশাক দিয়ে দায়িত্ব শেষ হয় না। সন্তানকে মানুষ করতে হলে সময় দিতে হয়, ভালো-মন্দ বুঝিয়ে দিতে হয়, তাদের সঙ্গে খোলামেলা সম্পর্ক রাখতে হয়। পরিবার যদি সচেতন না হয়, যদি সময় না দেয়, তাহলে এই ফাঁক থেকেই জন্ম নেয় উদভ্রান্ত কিশোর মন। তারা খোঁজে ভুল সঙ্গ, ভুল পরিচয়।
আমি নিজে বাবা। জানি, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা মানে কেবল আদর নয়—সঠিক পথে রাখার জন্য শাসনও দরকার। আমার প্রার্থনা, আমার ছেলেটা যেন কখনো এমন না হয়। আর কারো ছেলেও যেন এমন না হয়। এখনই সময়—পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—সবাইকে একসঙ্গে ভাবতে হবে। আজকের এই কিশোর গ্যাং যেন আগামী প্রজন্মের অভিশাপ না হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা যদি আজ সচেতন না হই, যদি আমাদের সন্তানদের সময় না দিই, তাহলে আগামী দিনে আমাদেরই সন্তানদের নাম উঠবে এমন গ্যাংয়ের তালিকায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে এখনই সতর্ক হতে হবে। কারণ, একটা কিশোরের বিপথগামী হওয়া মানে শুধু তার একার পতন নয়, পুরো সমাজেরই ক্ষতি।
(কালের কণ্ঠ । ০৮ জুন ২০২৫)
মন্তব্যসমূহ