অপরূপ শ্বেতশুভ্র পাহাড়ে শিহরন
যেদিকে চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ। মনে হয় কোনো এক বরফরাজ্যে এসেছি। তুষারমুকুট মাথায় পরে বরফের চাদরে মুখ ঢেকে রেখেছে রাস্তার দুপাশের পর্বতগুলো। কনকনে বাতাস, নরম আলো আর চারদিকের শ্বেতশুভ্র পাহাড় মনে শিহরন জাগায়। কিন্তু ১৫ হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতার এই ইয়ামসামডংয়ে ওঠার কিছুক্ষণ পরই আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তারপরও চীন সীমান্তঘেঁষা উত্তর সিকিমের এই আশ্চর্য-সুন্দর বরফরাজ্য দেখে সেই কষ্ট-ক্লেদ মুহূর্তেই উবে যায়।
ইয়ামসামডং বা জিরো পয়েন্ট সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ হাজার ৩০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এরপরে বেসামরিক লোকজনের চলাচল নিষিদ্ধ। নিরাপত্তার খাতিরে ওই এলাকা পার হতে দেওয়া হয় না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই জিরো পয়েন্ট এক সময় বাংলাদেশিদের জন্য নিষিদ্ধ থাকলেও বর্তমানে শর্তসাপেক্ষে খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন হাজারো বাংলাদেশি ভিড় জমাচ্ছেন এখানে।
পৃথিবীর ছোট্ট স্বর্গ এই সিকিম যাওয়ার ইচ্ছা ছিল অনেক দিনের। কিন্তু সময়-সুযোগ হচ্ছিল না। মানিকগঞ্জ প্রেস ক্লাব সেই সুযোগটি তৈরি করে দেয়। অফিস থেকে ছুটিও পেয়ে যাই। গত ৩০ এপ্রিল ৩৬ জনের একটি টিম নিয়ে এসআর ট্রাভেলসের এসি কোচে বুড়িমারী পর্যন্ত যাই। সেদিন চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডার দিয়ে ইমিগ্রেশন পার হতে আমাদের বিকেল হয়ে যায়। এত মানুষ ভারতে যাচ্ছে কল্পনাও করা যায় না। এরপর শিলিগুড়িতে গিয়ে দুপুরের খাবার সন্ধ্যায় খেয়ে; গাড়ি পরিবর্তন করে সিকিমের উদ্দেশে রওনা দিই।
শিলিগুড়ি থেকে কিছু দূর যাওয়ার পরই চোখে পড়বে সেভক ফরেস্ট রোডের দুই পাশের জারুল, শাল আর সেগুনের অরণ্য। এর সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরানো যায় না। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা পার হয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে যায়। পাহাড়ের গায়ে উঁচু-নিচু রাস্তা আপনাকে রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি দেবে।
সিকিম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি রাজ্য। তিব্বত, ভুটান আর নেপাল বেষ্টিত এই রাজ্যের রাজধানী গ্যাংটক। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ৫ হাজার ফুট ওপরে। আয়তনের দিক দিয়ে ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য হলেও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে সিকিম অত্যন্ত জনপ্রিয়। আলপাইন চারণভূমি, পাহাড়, হিমবাহ ও হাজারো বুনো ফুলে ভরা সিকিম পর্যটকদের মুগ্ধ করে। সিকিমের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো যে ঋতুতেই আপনি সেখানে যান না কেন, সৌন্দর্য একই থাকে।
সিকিমের রংপোতে পৌঁছাতে আমাদের রাত ১২টা বেজে যায়। রংপোকে বলা যায়, সিকিম প্রবেশের ইমিগ্রেশন। ভারতীয় ছাড়া অন্য দেশের পর্যটকদের সিকিমে প্রবেশ করতে আলাদা অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে। একদিন আগে ছবি, পাসপোর্ট, ভিসা ও করোনার সার্টিফিকেটের কপি নিয়ে অনুমতি নিতে হয়। এই রংপোতে এসে মূল পাসপোর্টের সঙ্গে সেই অনুমতিপত্র জমা দিতে হয়। চেকপোস্ট থেকে অনুমতিপত্র চেক করে পাসপোর্টে সিল মেরে দেওয়া হয়।
রংপো পার হয়ে ভোরের দিকে আমরা গ্যাংটকে আমাদের হোটেলে গিয়ে পৌঁছাই। টানা একদিন দুই রাত জার্নিতে সবাই বেশ ক্লান্ত। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন হোটেলে বড় ব্যাগগুলো রেখে দুপুরের দিকে লাচুংয়ের উদ্দেশে রওনা দিই। পথিমথ্যে সেভেন সিস্টার্স ওয়াটারফল দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। আমরা যখন এর কাছে পৌঁছি তখন হালকা বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যেই নেমে যাই সবাই। এটি ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় জলপ্রপাত। বর্ষাকালে যখন পানি কমে যায়, তখন এটি দেখার সেরা সময়। অরণ্যঘেরা পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে নামলে জলপ্রপাতের সৌন্দর্য বহু গুণ বেড়ে যায়।
রাতে গিয়ে পৌঁছি লাচুংয়ের হোটেলে। লাচুং উত্তর সিকিমের একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। প্রকৃতির কোলে যেন ছবির মতো সেজে আছে। তিব্বতের সীমান্তঘেঁষা এ গ্রামে জনবসতি খুবই কম। আকাশ ছুঁয়েছে পাইন, ফার আর ধুপিগাছের সারি। আর আছে নানা প্রজাতির রডোডেনড্রন। ৯ হাজার ৬০০ ফুট উচ্চতার এত সুন্দর, নিরালা ছবির মতো গ্রাম সিকিমে খুব কমই পাবেন।
লাচুংয়ের হোটেলে রাত কাটিয়ে আমরা পরদিন সকালে ইয়ামথাং ভ্যালির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। লাচুং থেকে এর দূরত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার। আপনি লাচুং যাবেন আর ইয়ামথাং ভ্যালিতে যাবেন না এটা হয় নাকি! এটি প্রায় ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লাচুংয়ের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। পাহাড় আর রডোডেনড্রন অভয়ারণ্য ঘেরা এই ভ্যালি পাহাড়প্রেমীদের কাছে অত্যন্ত পছন্দের।
ইয়ামথাং ভ্যালিতে গিয়ে আমাদের শীতের পোশাকে আর কুলাচ্ছিল না। গাইডের পরামর্শে ভ্যালিতে থাকা দোকান থেকে জ্যাকেট ও গামবুট ১০০ রুপি করে ভাড়া করে নিই সবাই। এরপর সামনের দিকে এগুতে থাকি। ইয়ামথাং ভ্যালি থেকে জিরো পয়েন্টের দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। চীন সীমান্তের কাছাকাছি বলে সাধারণ পর্যটকদের এই পর্যন্তই যাওয়ার অনুমতি মেলে। ১৫ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ইয়ামসামডং বা জিরো পয়েন্টের অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নজর কাড়বেই। ইয়ামথাং ভ্যালি পর্যন্ত আসতে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। এই ভ্যালি থেকে ২৬ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে ইয়ামসামডংয়ে আসতেই সঙ্গে থাকা অনেকেরই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় বমি হয়েছে।
পর্যটকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় উত্তর সিকিমের এই ভ্রমণ। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অত্যধিক বরফ থাকে। এপ্রিল-মে মাসে এটি ভরে থাকে বিভিন্ন রঙের রডোডেনড্রনে। সঙ্গে প্রিমুলা ও অন্য নানা প্রজাতির ফুলও শোভা বাড়ায়। বছরের বাকি সময় চোখজুড়োনো সবুজ উপত্যকা, তার বুক চিরে বয়ে যাওয়া নীল নদী, তুষারমুকুট মাথায় পরা পর্বতমালা দারুণভাবে আকর্ষণ করে।
জিরো পয়েন্ট থেকে চলে যাই ইয়ামথাং ভ্যালিতে। সেখানে ভাড়া করা পোশাক-বুট জমা দিয়ে সোজা চলে যাই হোটেলে। গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েই গ্যাংটকের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। গ্যাংটকের হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত। সকালে ঘুম ভেঙে বাইরে তাকিয়ে আমি তো অবাক! কী সুন্দর দৃশ্য! নীল আকাশে যেন মিশে গেছে পাহাড়। গোটা শহরটি পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে আছে এমজি মার্গ বা মহাত্মা গান্ধী মার্গ।
সকালের নাশতা সেরে আমরা বেরিয়ে পড়ি ছাঙ্গু লেকের দিকে। গ্যাংটক থেকে এটি ৩৮ কিলোমিটার দূরে। ১২ হাজার ফুট ওপরে অবস্থিত এই ছাঙ্গু লেকটির স্থানীয় নাম সোমগো। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই লেক রঙ পরিবর্তন করে। বছরের বেশিরভাগ সময়ে এটি বরফে ঢাকা থাকলেও এখন টলটলে নীল জল। লেকে ভেসে বেড়ায় পরিযায়ী পাখির দল। তবে শীতকালে লেকের পানি জমে বরফ হয়ে যায়। লেকের চারদিকে বরফে ঢাকা পাহাড়ের সৌন্দর্যই অন্যরকম।
ছাঙ্গু লেকে এসে ইয়াকের পিঠে না চড়লে কেমন হয়! এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকরা একবার হলেও ইয়াকের পিঠে চড়েন। কনকনে বাতাস, নরম আলোর সঙ্গে লেকের নীল জল আর বরফের পাহাড়ের পাশে ইয়াকের ওপরে বসে চলা এক আশ্চর্যসুন্দর অনুভূতি।
গ্যাংটকে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছু সময় বিশ্রাম। এরপর সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়ি এমজি মার্গের দিকে। এটি গ্যাংটকের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান। সুন্দর সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো। মাঝখানটায় বসার জায়গা আর দুই পাশে সুসজ্জিত দোকানপাট, পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। এমজি মার্গে মহাত্মা গান্ধীর খুব সুন্দর একটি মূর্তি আছে। সেখানে গেলে একটি ছবি অবশ্যই তুলতে হবে।
গ্যাংটকের হোটেল দ্য রাইস ভ্যালি রেসিডেন্সির ম্যানেজার শিবাজি জানান, প্রতিদিন ৮০০ গাড়ি আসে এই গ্যাংটকে। এর মধ্যে ৩০০টি গাড়িই বাংলাদেশিদের। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রতি গাড়িতে গড়ে ৮ জন মানুষ ধরলেও প্রতিদিন সাড়ে ৬ হাজার মানুষ আসছেন।
মনে রাখতে হবে, লাচুং ও ছাঙ্গু লেকে যাওয়ার জন্য পর্যটকদের অনুমতিপত্র নিতে হয় গ্যাংটক থেকেই। আর গ্যাংটকে যাওয়ার জন্য অনুমতিপত্র নিতে হয় শিলিগুড়ি থেকে। পাসপোর্ট, ভিসা, করোনার সার্টিফিকেট ও ছবি দিয়ে আবেদন করলে সহজেই মেলে এই অনুমতিপত্র। আবেদন করতে হয় আগের দিন। শিলিগুড়ি বা গ্যাংটকের হোটেল বা যেকোনো ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে ডকুমেন্টগুলো জমা দিলে তারাই অনুমতিপত্র এনে দেবে। সিকিমে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করা যায় না। প্রকাশ্যে ধূমপানও করা যায় না। ময়লা-আবর্জনা ও থুথু ফেলা যায় না। বিশেষ করে লাচুং যাওয়ার সময় চেকপোস্টের আগেই প্লাস্টিকের বোতলটিও ফেলে দিতে হয়।
(দেশ রূপান্তর । ১২ মে ২০২৩)
মন্তব্যসমূহ