বাড়ি থেকে পালাতে চান?


টিনের ট্রাংক মাথায় নিয়ে দিলাম দৌড়! পায়জামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে মাথায় টুপিও আছে। জোরে দৌড়াচ্ছি। মনে হলো স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেল! স্যান্ডেলটি পা থেকে ছুড়ে ফেলে প্রায় হাঁটুপানির মধ্যেই দৌড়াচ্ছি। যেন শর্টকাটে মহাসড়কে গিয়ে উঠতে পারি।... শৈশবে বাড়ি থেকে আমিও পালিয়েছিলাম। আনকাটে আজকের পর্বে থাকছে বাড়ি থেকে পালানোর গল্প। শৈশবের দুরন্তপনার গল্প চিপ্পার গল্প।

ফুটপাতে বড় হয়েছে চিপ্পা। ফুটপাতে থাকে। ফুটপাতের নিয়ন আলোতেই লেখাপড়া করে। মা নেই। বাবা চলে গেছেন অন্যত্র। চিপ্পা এক নারীর চায়ের দোকানে ফুট-ফরমায়েশ খাটে। তার সঙ্গেই থাকে। কিন্তু সে ওই নারীর কথা ঠিকমতো শুনতে চায় না। তার এখানে ভালো লাগে না। সে তার মতো করে অন্যত্র থাকতে চায়।

চিপ্পার দশম জন্মদিনে তার হাতে আসে এক চিঠি। তার বাবার লেখা। চিঠির ভাষা উর্দু। চিঠিতে কী লেখা সেটি জানতে চিপ্পা অস্থির হয়ে পড়ে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে, যে তাকে চিঠিটি পড়ে বুঝিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আশপাশের কেউই উর্দু পড়ে বোঝাতে পারে না। চিপ্পা ভাবে, বাসা থেকে পালাতে হবে। দূরে কোথাও গিয়ে চিঠির অর্থ জানতে হবে আবার স্বাধীনভাবে কাজও করা যাবে। চিপ্পা সেই রাতেই ফুটপাতের ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।

প্রথমে চিপ্পার সঙ্গে দেখা হয় একজন মাতালের; যিনি ট্যাক্সি ভাড়া কম দিয়েই রওনা দিয়েছেন। এরপর আলাপ হয় এক ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে; তার ট্যাক্সিতে ঘুরে বেড়ায়। তার সঙ্গে চা খায়। তাকে বলে, তুমি কি উর্দু পড়তে পারো? ট্যাক্সিচালক বলে, না। তারপর তারা মহল্লায় ফুটবল খেলা দেখে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচ। চালক বলে, কে জিতবে? চিপ্পা বলে, আমাদের মেসি।

চিপ্পার আলাপ হয় এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে। তিনি চিপ্পাকে বলেন, এই কোথায় থাকিস? বাড়ি কোথায়? চিপ্পা বলে, জানি না। অফিসার বলেন, কোথায় যাবি? চিপ্পা এবারও বলে, জানি না। পরে অফিসার বলেন, বাইকে উঠবি? ও হ্যাঁ বলে। ওই পুলিশ অফিসার তাকে বাইকে উঠিয়ে ঘুরে বেড়ায়। চিপ্পা তার কাছেও জানতে চায়, তুমি কি উর্দু পড়তে পারো? তিনি না করেন। এরপর চিপ্পাকে এক মিষ্টি বিক্রেতার কাছে রেখে যান।

এরপর একে একে চিপ্পার সঙ্গে দেখা হয় হিজড়া, পতিতা, ব্যান্ড পার্টির বাদকদের। দেখা হয় খেটে খাওয়া মানুষ, ধনীর দুলাল, ডাকপিয়নের সঙ্গেও। জুটে যায় এক কুকুর ছানাও। চিপ্পা যার নাম রাখে পিপ্পা। চিপ্পা বলে, আমি চিপ্পা, আর তুই পিপ্পা। রাত ফুরিয়ে আসার সময় চিপ্পার আলাপ হয় এক সংবাদপত্রের কর্মীর সঙ্গে। তিনি তাকে আরেকজন সংবাদকর্মীর কাছে যেতে বলেন। যিনি উর্দু পত্রিকার হকার।

চিপ্পা তার কাছে গিয়ে বলে, আপনি খবরের কাগজ বিক্রি করেন? তিনি বলেন, হুম। চিপ্পা জানতে চায়, আপনি কি উর্দু পড়তে পারেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ! এবার চিপ্পা তার বাবার লেখা সেই চিঠিটি বের করে দেয়। লোকটি চিঠিটি পড়ে আর তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ে। চিপ্পাকে বলেন, এটা তো আবছা হয়ে গেছে। চিঠিটি পুরনো হয়ে গেছে। লোকটি বলেন, একটা কাজ করবি আমার জন্য? থাকার জায়গা পাবি! তিনি চিপ্পাকে তার বাসায় নিয়ে যান। কিন্তু তার বউ বাগড়া দেয়; চিপ্পা চলে যায়।

মফস্বল শহরে সারা রাত ঘুরে ঘুরে কোনো কাজ পায় না চিপ্পা। বাবার চিঠিটিও কাউকে দিয়ে পড়াতে পারে না। নানা মানুষের নানান সমস্যা দেখে চিপ্পা হতাশ হয়ে রাস্তার পাশের একটি দোকানের সামনে গিয়ে বসে। ততক্ষণে সকাল হয়ে যায়। ওই দোকানি এসে চিপ্পাকে একটি লাথি মেরে সরিয়ে দিয়ে দোকান খোলেন। দেখেন তার দোকানে চুরি হয়েছে। চিপ্পাকে চোর চোর বলে ধাওয়া করেন। লোকজন জড়ো হয়ে তাকে ধরে মারতে থাকে। রাতে দেখা হওয়া সেই পুলিশ অফিসার চিপ্পাকে উদ্ধার করে তার বাইকে বসান। পুলিশ অফিসার বলেন, এখন যাবি কই? চিপ্পা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বাড়ি। পুলিশ অফিসার বলেন, ক্যান? হয়ে গেল? চিপ্পা বলে, জীবন তো সবে শুরু হলো।

সব মিলিয়ে মফস্বল শহরের এক রাতের অ্যাডভেঞ্চার ‘চিপ্পা’। যারা বাড়ি থেকে পালাতে চান; তারা অবশ্যই দেখবেন সিনেমাটি আর যারা পালানোর প্ল্যান করছেন তারাও দেখবেন। আর আমার মতো যারা ছোটবেলায় পালিয়েছেন তারাও!

(দেশ রূপান্তর । ১১ জানুয়ারি ২০২৪)

মন্তব্যসমূহ