বকবক করা মেয়েটিই ‘প্রথম নারী ফুটবল ধারাভাষ্যকার’
মেয়েটি সারাক্ষণ বকবক করে। শোয়ার সময়, খেলার সময়, পড়ার সময় এমনকি খাওয়ার সময়ও। মায়ের সঙ্গে, বাবার সঙ্গে, ভাইয়ের সঙ্গে, এমনকি বন্ধুদের সঙ্গেও বকবকানি চলতেই থাকে। টিভিতে টম অ্যান্ড জেরি হোক আর কোনো ফুটবল খেলাই হোক— মেয়েটির বর্ণনা থামেই না। মেয়েটি কখনোই তার মনের কথা বলতে পিছপা হয় না। তার বকবকানিতে বাবা-মা-ভাই-সহপাঠী-বন্ধুরা একেবারেই অতিষ্ঠ।
মেয়েটির নাম ফাতিমা নূরজাহান। কখনো ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে গোল পোস্টে দাঁড়িয়ে যাওয়া; কখনো রাত জেগে টিভিতে প্রিয় দলের খেলা দেখা। সে ফুটবল ভক্ত। তার প্রিয় খেলাও ফুটবল। গোল হওয়ার সময় ফাতিমা দুই আঙুল মুখের ভেতর দিয়ে শিস দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। বড় ভাই শিখিয়ে দেয় না। মায়ের কাছে যায়। মা রান্না ঘরে ডেকে নিয়ে তাকে শিস কীভাবে দিতে হয় সেটা শিখিয়ে দেন।
স্কুল শেষে কলেজ পার করলেও তার বকবকানি চলতে থাকে। তার বান্ধবীকে যে ছেলে প্রপোজ করেছে সে আসবে দেখা করতে। ফাতিমাকে তার বান্ধবীরা বলে, তোকে সঙ্গে নেব, কিন্তু তুই মুখ বন্ধ রাখবি। সে রাজি হয়, কিন্তু সেদিন তার কথার বাণে পড়ে ছেলেটিই নাস্তানাবুদ হয়ে ফিরে যায়।
একবার এলাকায় তার বড় ভাই ও বন্ধুরা ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। এলাকার এমপিকে প্রধান অতিথি করা হয়। বিশেষ অতিথি হবেন বিখ্যাত এক ফুটবল খেলোয়াড়। কিন্তু সমস্যা হয়, খেলার আগের দিন যে ধারাভাষ্য দেবে, তাকে পাওয়া যায় না। মেয়েটির ভাই ও তার বন্ধুরা খুব ঝামেলায় পড়ে যায়। একজন তার ভাইকে জানায়, তোর বোনকে নিয়ে আয় মাঠে। ও যে কথা বলে, ও-ই ধারাভাষ্যটা দিক।
ফাতিমাকে অনেক বলে-কয়ে মাঠে নিয়ে যায় তার বড় ভাই। গ্যালারি তখন কানায় কানায় ভর্তি। প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথি এসেছেন। মাঠে নামছেন খেলোয়াড়রাও। ফাতিমা স্টেজে মাইক হাতে দাঁড়িয়ে। সে যখন বলা শুরু করে তখন দর্শক-খেলোয়াড় খেলা দেখা বন্ধ করে ফাতিমাকে দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। কেউ ভিডিও করে। কেউ বাহবা দেয়।
ফাতিমার ধারাভাষ্য শুনে এলাকার এমপি এবং অতিথি খেলোয়াড়ও খুব প্রশংসা করেন। খেলা শেষে ফাতিমাকে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে এমপি বলেন, ‘তোমার কণ্ঠটা ঈশ্বরের দান। এটাকে জিইয়ে রেখো।’ ফাতিমার চোখ-মুখ যেন খুশিতে নেচে ওঠে! তার বড় ভাই, বড় ভাইয়ের বন্ধুরা— সবাই তার লাইভ ধারাভাষ্যে মুগ্ধ হয় এবং প্রশংসা করে।
এরপর ফাতিমা ‘টক অব দ্য টাউন’ হয়ে ওঠে। যেখানেই খেলা হয়, ফাতিমাকে ধারাভাষ্যকার হিসেবে ডেকে নেয়। কোনো বিষয়ের মাইকিংয়ের প্রয়োজন হলেও ডাক পড়ে ফাতিমার। তাকে দেখে এলাকার ছেলে-মেয়েরা সেলফি তোলে। এরপর থেকে সে জাতীয় ফুটবল লিগের ধারাভাষ্যকার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
এর মধ্যেই ফাতিমার পরিবার তার বিয়ের জন্য প্রস্তাব দেন। ছেলেও দেখতে আসে কিন্তু তার বকবকের কারণে এটি বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু ফাতিমা থেমে থাকে না। ফাতিমা তার এক সাংবাদিক বান্ধবীর সাহায্যে ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি, ব্রডকাস্ট ডিরেক্টর, স্পোর্টস একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা এমনকি ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করে। কিন্তু কোনো সাহায্য পায় না। তাকে অপমান করে বলা হয়, ফুটবল ধারাভাষ্য একটি পুরুষ-শাসিত ক্ষেত্র। এখানে নারী কণ্ঠ উপযুক্ত নয়।
ফাতিমার সামনে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা চলে আসে— তার পরিবার, সমাজ এবং ফুটবলের পুরুষ শাসিত গভর্নিং বডির বিরোধিতা। সব মিলিয়ে একটি মধ্যবিত্ত, গোঁড়া মুসলিম পরিবারের বকবক করা একজন শিক্ষিত তরুণীর ধারাভাষ্যকার হয়ে ওঠার গল্পটি একটি মালায়ালাম সিনেমার, যার নাম ‘সেশাম মাইক-ইল ফাতিমা’। এই নারীকেন্দ্রিক সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন একজন সাংবাদিক— মনু সি কুমার। এটি লিখেছেনও তিনি।
ফাতিমার চরিত্রটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, দর্শকরা প্রথম থেকেই বুঝতে পারেন তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু তারপরও দর্শককে শেষ পর্যন্তই অপেক্ষা করতে হবে ফাতিমার লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গী হওয়ার। ফাতিমার যাত্রাকে আকর্ষণীয় ও সুন্দর করে তুলতে পরিচালক সফল হয়েছেন। সিনেমাটিতে প্রথাগত গোঁড়ামি ভেঙে নারীকে তার উপযুক্ত স্থান দেওয়া হয়েছে।
(দেশ রূপান্তর । ১৮ জানুয়ারি ২০২৪)
মন্তব্যসমূহ