নেতাদের মাদক আসক্তি—সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর বার্তা
নেতা শব্দটির মধ্যেই আছে আস্থা, দায়িত্ব আর অনুপ্রেরণা। সাধারণ মানুষ যখন কাউকে নেতা হিসেবে মেনে নেয়, তখন তাকে কেবল রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষমতার জন্য নয়, ব্যক্তিত্ব ও নৈতিকতার জন্যও অনুসরণ করে। তাই একজন নেতার প্রতিটি আচরণ, কথা ও অভ্যাস অগণিত মানুষের কাছে বার্তা হয়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে দৃশ্যগুলো আমরা দেখছি, তা হতাশা আর ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে।
কিছু দিন আগে আমার নিজের জেলায় উপজেলা পর্যায়ের এক নেতার মাদক সেবনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। দৃশ্যে দেখা গেছে, বিশেষ এক প্রক্রিয়ায় মাদক গ্রহণের পর তিনি ধোঁয়া ছাড়ছেন আয়েশি ভঙ্গিতে। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে—একজন নেতার মাদক সেবনের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর দল থেকেও তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। প্রশ্ন আসে, এই প্রবণতা কি দিন দিন বাড়ছে?
এই ধরনের ভিডিও সাধারণত খুব কাছের মানুষরাই প্রকাশ করে। ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, রাজনৈতিক সহযোদ্ধা কিংবা ব্যক্তিগত সহকারী—কেউ একজন ভিডিও করে তা ছড়িয়ে দেন। কারণ হতে পারে ব্যক্তিগত শত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা ক্ষমতার লড়াই। কিন্তু যে কারণেই হোক, ভিডিওর বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। মানুষের সামনে তখন প্রকৃত চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে যায়। এখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু মূল প্রশ্ন থেকে যায়—নেতা হয়েও মাদকে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা কেন?
রাজনীতি মানুষকে নেতৃত্বের সুযোগ দেয়। জনগণের ভোট, সমর্থন ও ভালোবাসায় নেতারা উঠে আসেন। তাদের প্রতিটি কাজ সাধারণ মানুষের চোখে ধরা পড়ে। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন মাদকাসক্ত হন, তখন তা শুধু তার ব্যক্তিগত জীবনকেই নয়, পুরো সমাজকেই প্রভাবিত করে। কারণ মানুষ তাদের অনুসরণ করে, তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়। একজন সাধারণ মানুষ ভুল করলে তা ব্যক্তিগত ব্যাপার; কিন্তু নেতা ভুল করলে সেটি সামাজিক সংকট হয়ে ওঠে।
মাদক সেবন কেবল একটি নৈতিক ব্যর্থতা নয়; এটি এক ভয়াবহ সামাজিক বার্তা। একজন নেতার আসক্তি মানে তার চারপাশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এমন এক ক্ষতিকর উদাহরণ দেখতে পাবে যা তাদেরও বিপথে নিতে পারে। “যদি নেতা পারেন, আমি কেন পারব না” —এমন ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এভাবে একে একে নষ্ট হয় সামাজিক মূল্যবোধ, দুর্বল হয় নৈতিকতা।
প্রত্যেক মানুষেরই কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকে। কিন্তু নেতা হওয়ার অর্থই হলো সেই দুর্বলতাকে নিয়ন্ত্রণ করা, নিজেকে সংযত রাখা, দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে জীবনযাপন করা। ভুল স্বীকার করে সংশোধনের সুযোগ সবারই আছে, কিন্তু মাদক সেবনের মতো জঘন্য কাজে জড়ানো নেতৃত্বের মর্যাদাকে চূর্ণ করে দেয়। যে দায়িত্ব জনগণ তাদের হাতে তুলে দিয়েছে, সেই দায়িত্বের প্রতি এমন অবহেলা ক্ষমার অযোগ্য।
এই বাস্তবতায় সমাজকেও ভাবতে হবে। আমরা কি শুধুই ভিডিও ভাইরাল হলে সরব হব, নাকি আগে থেকেই নেতাদের চরিত্র ও কাজের মূল্যায়ন করব? রাজনৈতিক দলেরও দায়িত্ব আছে। প্রার্থী মনোনয়নের সময় তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও অভ্যাস সম্পর্কে কঠোর যাচাই-বাছাই করা উচিত। শুধুমাত্র বক্তৃতার জোর বা জনপ্রিয়তার কারণে নয়, চরিত্র ও সততার ভিত্তিতে নেতৃত্ব বাছাই করা প্রয়োজন। দলীয় শৃঙ্খলা মানতে ব্যর্থ হলে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সামাজিক সচেতনতাও সমান জরুরি। আমরা সাধারণ মানুষ যদি অন্ধ সমর্থনে নেতাদের উঁচু আসনে বসাই, তবে তারা ভাববে—সবই ক্ষমাযোগ্য। কিন্তু প্রকৃত নৈতিক নেতৃত্বকে অনুসরণ করতে শিখতে হবে। যারা সত্যিকারের সৎ, নীতিবান ও মাদকমুক্ত জীবনযাপন করেন, তারাই সমাজকে আলোকিত করতে পারেন। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, তাদের শক্তি জোগাতে হবে।
মাদক এখন শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির কারণ নয়; এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতারও উৎস। একবার আসক্তি তৈরি হলে ব্যক্তি সহজেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মাদক ব্যবসায়ী চক্র ও অপরাধীরা এই সুযোগ নেয়। একজন নেতা যদি এতে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে পুরো প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে যায়। আইন প্রয়োগকারীদের ওপর চাপ তৈরি হয়, অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন নেতা তখনই সত্যিকার নেতা, যখন তিনি নিজের জীবনকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে পারেন। সমাজ তাকে অনুসরণ করবে তার নীতির কারণে, তার দুর্বলতার কারণে নয়। তাই নেতাদের মাদকমুক্ত, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল জীবনযাপন করতে হবে। আর জনগণকেও চোখ-কান খোলা রাখতে হবে—অন্ধ সমর্থন নয়, সত্যিকারের নেতাকেই অনুসরণ করতে হবে।
ভাইরাল ভিডিও হয়তো কিছু সময়ের জন্য তুমুল আলোচনা তৈরি করে। কিন্তু তাতে যদি সমাজের ভেতর থেকে কোনো পরিবর্তন না আসে, তাহলে সমস্যা থেকেই যাবে। তাই প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা ও পদক্ষেপ। আমাদের সবার, বিশেষ করে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও সচেতন নাগরিকদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধু মাদকবিরোধী স্লোগান নয়, বাস্তবে কঠোর প্রয়োগ ও মূল্যবোধের চর্চাই পারে সমাজকে এই ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে।
নেতৃত্বের মানে কেবল ক্ষমতা নয়, এটি একটি দায়বদ্ধতা। মাদক নয়, সততা ও দায়িত্ববোধই হোক সেই নেতৃত্বের প্রকৃত পরিচয়। সমাজ তখনই নিরাপদ হবে, যখন নেতারা নিজেদের সীমা জানবেন, আর জনগণ জানবে কাকে অনুসরণ করতে হবে।
(যুগান্তর । ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫)
মন্তব্যসমূহ