‘আল্লাহর নম্বরে’ ফোন করে ছেলের আকুতি—‘আব্বুকে ফিরিয়ে দাও’
ছেলেটি প্রতিদিন তার বাবার জন্য অপেক্ষা করে। পড়ার সময়, ঘুমের সময়, শোওয়ার ঘরে, স্কুলবাসে, রাস্তায়, মসজিদে এমনকি ক্লাসের ফাঁকেও বাবার ফিরে আসার অপেক্ষা করে। বাবার সঙ্গে তার অনেক স্মৃতি। নৌকায় চড়া, সাইকেলে ঘুরে বেড়ানো। বাবা তার জুতার ফিতাটিও বেঁধে দিয়েছেন। বছরখানেক আগে তার বাবা বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি।
বাবার একটিই ছবি আছে তার কাছে। সেটিই সে বুকে আগলে রাখে। একদিন স্কুলে সেই ছবি দেখে তার এক বন্ধু বলে, তোর বাবা তো আল্লাহর কাছে চলে গেছে। সে জানতে চায়, তুই কীভাবে জানলি আব্বু আল্লাহর কাছে? তার বন্ধু বলে, আমার নানি বলেছে। আল্লাহর যাকে দরকার তাকে কাছে ডেকে নেয়। ছেলেটি ভাবে, আল্লাহ কেন মানুষকে ডেকে নেয়!
ছেলেটির বাবা ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। নৌকা তৈরি করতেন। আবার ভালো কবিতাও লিখতেন। বাবার অবর্তমানে আত্মীয়স্বজন ছেলেটিকে নৌকার কারখানায় যেতে বলে। কিন্তু তার মা তাকে পড়াতে চান। ছেলের খরচ-নিজের খরচের জন্য তিনি সেলাইয়ের কাজ করেন। বাসা-বাড়ি থেকে জামা-কাপড় এনে সেলাই করে দেন। এতে যা পান তা দিয়েই সংসার চালান। কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন তিনি। ছেলের প্রতি এতটা মনোযোগ আর নেই এখন।
ছেলেটি একদিন বাসায় একটি দাওয়াতের কার্ড দেখতে পায়। কার্ডের ওপরে ৭৮৬ লেখা দেখে সে তার মায়ের কাছে জানতে চায়, এটি কিসের নম্বর। তার মা বলেন, এটি আল্লাহর নম্বর। তখন ছেলেটি প্ল্যান করে সে আল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। সে তো আল্লাহর নম্বর পেয়ে গেছে। সে তার মাকে বলে, আম্মি, আম্মি, আল্লাহ অনেক ভালো; আল্লাহ অনেক সুন্দর, আল্লাহ গিটারও বাজায়। তার মা বলেন, এটি কে বলেছে। সে বলে, তার বন্ধু বলেছে।
একদিন সে তার মামার কাছে জানতে চায়, আপনি কি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন? তার মামা বলেন, আল্লাহর সঙ্গে সবাই কথা বলতে পারে না। তোমার বাবা অনেক ভালো কারিগর ছিলেন, তাই আল্লাহ তার সঙ্গে কথা বলেছেন। বাসায় ফিরে ছেলেটি তার মাকে বলে, আম্মি, আব্বুর বাক্স চাই। আমি কারখানায় যাব, কারিগর হব। তার মা জানতে চান কেন? ছেলেটি বলে, আব্বু একা একা জান্নাতের মেরামত করছে তাই তার আসতে দেরি হচ্ছে। তার মা কিছুটা উদাস হয়ে বাবার সেই বাক্সটা বের করে দেন।
সে তার বাবার হাতুড়-বাটালের বাক্সের ভেতরে একটি মোবাইল পায়। সে ভাবে, মোবাইলটি দিয়ে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলবে। এটি নিয়ে মোবাইলের দোকানে গিয়ে জানতে পারে ১০ টাকা রিচার্জ করলে কথা বলতে পারবে। কিন্তু তার কাছে তো মাত্র এক টাকা আছে। বাকি টাকা কোথায় পাবে? সে তার মায়ের কাছে গিয়ে পায় না। পরে মসজিদের সামনে যে ভিক্ষুক বসেন তার কাছে গিয়ে বলে, আমি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলব, আমাকে ৯ টাকা দাও। ভিক্ষুক তাকে তার প্লেট থেকে টাকা দিয়ে বলেন, যদি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে পারো, তাহলে আমার কথাটিও বলো।
এরপর সে মোবাইল রিচার্জ করে ৭৮৬ নম্বরে ফোন দেয়। কিন্তু ফোন যায় না। মোবাইলের দোকানে গিয়ে বলে, ফোন তো যায় না। দোকানি নম্বর জানতে চায়। ছেলেটি ৭৮৬ বলে। দোকানি বলে ১০ ডিজিট ছাড়া তো কল যাবে না। তখন ছেলেটি কোচিং ক্লাসের বিজ্ঞাপনের মোবাইল নম্বরের কায়দায় ৭৮৬ পরপর তিনবার লিখে তার আগে একটি কোড বসিয়ে ফোন দেয়। ফোন ধরেন একজন পোড়খাওয়া সেনাসদস্য। ছেলেটি বলে, আমি আপনার অনেক তারিফ করি। আমি আপনাকে ঠিকমতো জানি না, তা-ও তারিফ করি। সেনাসদস্য জানতে চান, কী তারিফ করো? ছেলেটি বলে, আপনি অনেক সুন্দর। আপনি অনেক ভালো। আর হ্যাঁ! আপনি ভালো গানও গাইতে পারেন।
ছেলেটি ওই সেনাসদস্যকে আল্লাহ মনে করেই কথা বলে। শুরু হয় তাদের এক অদ্ভুত সম্পর্ক। ছেলেটি তার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে বলে। বলে, আমার আব্বাকে বলবে, আমি আর দুষ্টুমি করব না। ঠিকমতো পড়ালেখা করব। মায়ের বিরুদ্ধে অনুযোগও করে। বলে, তার মা এখন আর আগের মতো নেই। সেনাসদস্য একবার ছেলেটির ফোন ধরার সময় একটু কাশি দেন। তখন ছেলেটি বলে, তোমারও কাশি হয়?
ছেলেটি তার বাবার চাদর মসজিদের দরজার সামনে দিয়ে আসে। পরের দিন দেখে মসজিদের সামনের সেই ভিক্ষুক তার বাবার চাদরটি পরে আছেন। সে বলে, এটা তুমি কোথায় পেয়েছ? ভিক্ষুক বলে, আল্লাহ দিয়েছে। সে ফের ফোন দিয়ে জানতে চায়, কেন চাদর সে ভিক্ষুককে দিয়েছে।
তার মায়ের সেলাইয়ের মজুরি দিতে চায় না লোকজন। ছেলেটি তাও সেই সেনাসদস্যকে ফোনে বলে দেয়। পরের দিন লোকজন এসে তার মায়ের পুরো টাকা দিয়ে যায়। তার বাবার গুম হয়ে যাওয়ার বিষয়ে খোঁজ নিতে থানায় যান সেনাসদস্য। গিয়ে তাগাদা দেন।
আরও যাদের স্বজন নিখোঁজ হয়েছে তারা ছেলেটির মাকে মৌন মানববন্ধন করতে নিতে আসে। তখন ছেলেটি সেই নম্বরে ফোন দিয়ে বলে, তার বাবাকে এক্ষুনি ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু একপর্যায়ে সেনাসদস্য তাকে জানায়, তার বাবা আর ফিরে আসবেন না। তিনি বেঁচে নেই। এ কথা শোনার পর ছেলেটির ভেতর যেন নড়েচড়ে গেল। শান্ত ছেলেটি প্রতিবাদে রাস্তায় গিয়ে সেনাসদস্যদের গাড়িতে একটি ঢিল ছুড়ে মারে।
সাত বছরের এই ছেলেটির নাম হামিদ। তার নামেই সিনেমাটির নাম। কাশ্মীরের ছোট্ট একটি ঘটনা কেন্দ্র করে আইজাজ খান বানিয়েছেন সিনেমাটি। হামিদ, হামিদের বাবা, হামিদের মা, তার বাবার হারিয়ে যাওয়া সবকিছুই কাশ্মীরের মানুষদের জীবনের কথা বলেছে। এতে একজন বাবা তার সন্তানের জন্য কতটা জরুরি, সেটা তুলে ধরা হয়েছে। বাবাদের হারিয়ে যাওয়া যে সন্তানদের জন্য কতটা কষ্টের, কতটা অসহায়ত্বের সেটিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। হামিদ দেখা যাবে নেটফ্লিক্সে।
(দেশ রূপান্তর । ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, কালের কণ্ঠ । ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪)
মন্তব্যসমূহ