বডি শেমিংকে জবাব দেওয়া এক অনুপ্রেরণার গল্প—‘৩৬২৪৩৬’
সিনেমার গল্পটি কোথায় শেষ হবে? হিসাব মেলাতে পারছিলাম না। বউ আর আমি বসে টানা দেখলাম সিনেমাটি। সচরাচর যা হয়, অন্য সিনেমা দেখতে বউ মাঝেমধ্যে উঠে চা বানায়, পপকর্ন নিয়ে আসে। কিন্তু এই সিনেমায়? একবারও উঠল না।
বরং আমাকে বারবার বলল, ‘হঠাৎ বাংলা সিনেমা দেখছ যে!’ সত্যিই! ‘৩৬২৪৩৬’—সিনেমাটি আপনিও যখন দেখবেন, শুরুতে ভাববেন, ‘একটু দেখি, তারপর উঠব।’ কিন্তু আস্তে আস্তে গল্পের ভেতরে এমনভাবে ঢুকে যাবেন, আর উঠতে পারবেন না।
প্রথমেই বলি
প্রতিটি মেয়েরই উচিত এ সিনেমাটি দেখা। কারণ এটি শুধু একটি সিনেমা নয়, এটি মেয়েদের জীবনের সেই অব্যক্ত যন্ত্রণার গল্প, যা চেহারার সৌন্দর্য বা শরীরের গড়ন নিয়ে সমাজের তির্যক মন্তব্যের মুখে বারবার শুনতে হয়।
মোটা হওয়া বা তথাকথিত সৌন্দর্যের সংজ্ঞার বাইরে থাকলে কিভাবে মেয়েদের সমাজে টিকে থাকতে হয়, সেই গল্প নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘৩৬২৪৩৬’।
গল্পের শুরু
সারা নামের এক মেয়ে। তার সঙ্গে অনলাইনে প্রেম হয় তাসহির নামের এক ছেলের। তিন মাস ধরে তারা মনের কথা শেয়ার করে, একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে অথচ একবারও মুখোমুখি হয়নি।
অবশেষে একদিন দুজন ডেটিংয়ে যায়। সারাটা দিন তারা একসঙ্গে কাটায়, হাসি-আনন্দে মেতে ওঠে। কিন্তু পরের দিনই তাসহিরের অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট হয়ে যায়। খবর আসে—তাসহির ক্যান্সারে মারা গেছে।
চার বছর পর
চার বছর কেটে যায়। সারা তার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসা অনেক বড় করে তোলে। হঠাৎ একদিন একটি ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের ইভেন্টে সারা হাজির হয়। আর সেখানেই ঘটে অবাক করার মতো ঘটনা। তাসহির, যে চার বছর আগে ক্যান্সারে মারা গিয়েছিল বলে সারা জানত, সে-ই এবার বিয়ের পাত্র! এখান থেকেই মুভির মূল গল্প শুরু হয়। প্রতিশোধ, মানসিক শক্তি আর জীবনের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির এক অনবদ্য কাহিনি ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়।
বডি শেমিংয়ের বিরুদ্ধে জোরালো বার্তা
এই সিনেমাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ দেয়—আপনি যেমনই হোন, নিজের প্রতি বিশ্বাস হারাবেন না। হতাশ হবেন না, কারণ হয়তো সৃষ্টিকর্তা আপনার জন্য উত্তম কারোর অপেক্ষায় রেখেছেন। এটি বডি শেমিংয়ের বিরুদ্ধে এক শক্ত প্রতিবাদ। মোটা হওয়া মানে আপনার মূল্য কম নয়। সারা তার জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলো পার করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং তার আত্মবিশ্বাস দিয়ে সবাইকে জবাব দিয়েছে।
অভিনয়ের চমক
সিনেমাটিতে কারিনা কাইসার এবং দীঘির অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। বিশেষ করে কারিনা কাইসার এমন নিখুঁত অভিনয় করেছেন, যা কল্পনার বাইরে। দীঘির চরিত্রটি ছিল একদম বাস্তবসম্মত।
পরিচালক সম্পকে কিছু না বললেই নয়
পরিচালক রেজাউর রহমান ‘৩৬২৪৩৬’-এর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে গল্প বলার ক্ষমতায় তিনি অনন্য। মোটা মেয়েদের প্রতি সমাজের বডি শেমিং, প্রেমের অধিকার এবং আত্মমর্যাদার সংগ্রামকে তিনি এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে দর্শক শুধু দেখবে না, অনুভব করবে। প্রতিটি দৃশ্যে আবেগের সূক্ষ্মতা ও টানটান উত্তেজনা ধরে রেখে, তিনি প্রমাণ করেছেন বাংলা সিনেমাও গভীরভাবে নাড়া দিতে পারে। এটাই তার পরিচালনার শক্তি—হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া।
শেষকথা
‘৩৬২৪৩৬’ চরকিতে দেখা যাবে। এটি শুধু একটি বিনোদনমূলক সিনেমা নয়, এটি এমন এক গল্প. যা আপনার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে এবং আপনাকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করবে। জীবনের যেকোনো প্রতিকূলতায় কিভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়, হার না মেনে এগিয়ে যেতে হয়, সেই মূল্যবান পাঠ দেবে এই সিনেমা।
(কালের কণ্ঠ । ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪)
মন্তব্যসমূহ