খাবারের টেবিলে শৃঙ্খলা, নৈতিকতা আর মানুষ হওয়ার পাঠ
কিছুদিন আগে বউ-বাচ্চা নিয়ে এক আয়োজনে গিয়েছিলাম। সকালের নাশতায় গিয়ে দেখি, টেবিল-চেয়ার ভরা-একটাও খালি নেই। দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। লাভ হলো না। কারণ প্লেটে খাবার শেষ হওয়ার আগেই নতুন অতিথিরা এসে যেন ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে। অস্বস্তিতে কেউ উঠে যাচ্ছে না, আবার অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকাটাও বড় বিব্রতকর। শেষে উপায় না দেখে নাশতা প্লেটে করে বাইরে একটা চেয়ার খুঁজে নিয়ে কোনোমতে খেতে হলো। তখনই মনে মনে ঠিক করলাম, দুপুরের লাঞ্চে একটু আগেভাগে গিয়ে টেবিল দখল করব। কিন্তু না! ঘণ্টাখানেক আগে পৌঁছেও দেখি, সব টেবিল আগে থেকে বুক করা!
কক্সবাজারের এক হোটেলের বুফেতে গিয়ে আরেকটা বিস্ময়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম। নোটিশ বোর্ডে বড় অক্ষরে লেখা- গতকাল এখানে ৩৫ কেজি খাবার নষ্ট হয়েছে। চোখ কপালে উঠল। সত্যিই তো! পাশে তাকিয়ে দেখি সেই একই দৃশ্য। অনেকে মনে করে, খেতে পারব-এই আশায় প্লেট বোঝাই করে খাবার তুলে নিচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খেতে না পেরে সেটা রেখে দিচ্ছে টেবিলেই। ওয়েটাররা সেই অর্ধেক খাওয়া বা ছোঁয়া হয়নি এমন খাবার ময়লার ঝুড়িতে ফেলছে। অথচ বুফের নিয়ম তো খুব সরল-যতবার খুশি, ততবার নিতে পারো। তাহলে এত লোভ কেন? এত অপচয় কেন?
আমরা যেমন ভাবি, খাবার পাওয়া যাবে কি না-এই শঙ্কায় আগে আগে গিয়ে টেবিলে দখল নিতে হবে। তেমনি ভাবি, খাবার থাকবে কি না-এই আশঙ্কায় প্লেট বোঝায় করে নিতে হবে। কেউ ভাবছি না, অন্য কারও জন্য কিছু রেখে যাওয়া উচিত। এমনকি অনেক মা-বাবা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের প্লেটে এমন বোঝাই করে খাবার তুলে দেন, যা বাচ্চারা শেষ করতে তো পারেই না-বরং অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায়।
আসলে খাবার শুধু প্রয়োজন নয়, এটা আল্লাহর এক মহামূল্যবান নেয়ামত। স্রষ্টার বান্দাদের প্রতি সীমাহীন অনুগ্রহ। প্রয়োজনমতো খাওয়া নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু অপচয় করা শুধু অপরাধই নয়, এটা স্পষ্ট গুনাহ। আমাদের আশেপাশেই তো এমন অনেক মানুষ আছে, যারা দিনের পর দিন না খেয়ে থাকে। অথচ আমরা রেস্টুরেন্টে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে এত খাবার নষ্ট করি, যার সামান্য অংশেও অনেক মানুষের পেট ভরতে পারত।
প্রশ্নটা এখন খুব জরুরি-শিক্ষা তো আমাদের কম নেই। ডিগ্রির অভাব নেই। কিন্তু মানুষকে মানুষ বানাবে কে? কোন পাঠ শেখালে এই জাতি পশুত্ব, অমানবিকতা, বিশৃঙ্খলা আর লোভের দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে? আমরা সভ্যতার বড় বড় বুলি আওড়াই, কিন্তু খাবারের টেবিলেই যদি শৃঙ্খলা, সংযম আর দায়িত্ববোধ না থাকে-তাহলে এই শিক্ষার দাম কোথায়?
খাবার নষ্ট করা মানে শুধু নিজের অযোগ্যতা প্রমাণ নয়, এটা এক ধরনের নৈতিক অধঃপতন। একবার ভেবে দেখুন, পৃথিবীর কোনো প্রাণী খাবারের অপচয় করে না। শুধু মানুষই এমন করে। অথচ মানুষের তো সবচেয়ে বেশি বুদ্ধি থাকার কথা। এত বুদ্ধি, এত শিক্ষা, এত আধুনিকতা-সবই যদি আমাদের একটু বিনয়, সংযম আর শৃঙ্খলা শেখাতে না পারে, তাহলে সেটার কোনো মূল্যই নেই।
খাবারের টেবিল আমাদের শেখাতে পারে-আসল শিক্ষা কী। শিখতে হবে, কতটুকু দরকার। শিখতে হবে, অন্যের অধিকার কীভাবে রক্ষা করতে হয়। শিখতে হবে, নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে। মানুষ হওয়ার জন্য বড় বড় ডিগ্রি লাগে না। লাগে শুধু বিবেক আর সচেতনতা।
(যুগান্তর । ২৮ জুন ২০২৫)
মন্তব্যসমূহ