একসময় সুরাইয়ার রক্তে চারপাশের মাটি লাল হয়ে আসে
আর মাত্র এক ঘণ্টা। তারপরই পাথর ছুড়ে মারা হবে সুরাইয়াকে। তিনি তার ছোট দুই কন্যাকে শেষবারের মতো বুকে টেনে নেন। আদর করেন। তার গলার মালাটা তুলে দেন বড় কন্যার হাতে আর চুড়ি দুটো পরিয়ে দেন ছোট কন্যাকে। সুরাইয়া তার ফুপুকে অনুরোধ করেন বড় হওয়ার পর তার কন্যাদের যেন জানানো হয় তার মা নিষ্পাপ ছিল।
প্রকাশ্যে রাস্তায় গর্ত খোঁড়া হয়। সুরাইয়াকে সেখানে নিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা হয়। গর্তের ভেতর নামিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয় কোমর পর্যন্ত। পাথর হাতে সুরাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লোকজন। তিনি প্রশ্ন করেন, কেন এমন করছেন আপনারা? সবাই বলে ওঠে, এটি আল্লাহর আইন। প্রথমে তার বাবা হাতে পাথর তুলে নেন। নিক্ষেপ করেন মেয়ের দিকে। কিন্তু লাগে না। আল্লাহর সায় নেই এতে বলে ওঠেন একজন।
পেছনে ড্রাম বাজার শব্দ। এবার সুরাইয়ার স্বামী পাথর তুলে নেন। গিয়ে লাগে কপালের ডান পাশে। সুরাইয়া কান্না না করে থাকতে পারেন না। পিছমোড়া করে বাঁধা হাত দুটো দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেন না। তার ছেলেদের দিয়েও পাথর মারতে বাধ্য করা হয়।
একসময় সুরাইয়ার রক্তে চারপাশের মাটি লাল হয়ে আসে। কপাল-মাথা-শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। শরীরের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। তখন তার স্বামী এসে রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে পরীক্ষা করে, তিনি বেঁচে আছেন কি না। সুরাইয়া বেঁচে ছিলেন অমন ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পরও। মরেননি বুঝতে পেরে স্বামী ও এলাকার লোকজন রক্তাক্ত পাথর কুড়িয়ে ফের ছুড়তে শুরু করে। একসময় সুরাইয়া মারা যান। এরপর দাফন না করে মরদেহটি বস্তায় ভরে নদীর পাড়ে ফেলে দেওয়া হয়।
কেন প্রাণ দিতে হলো সুরাইয়াকে? কী অপরাধ করেছিলেন তিনি? আসলে তিনি মিথ্যা ষড়যন্ত্রের শিকার। সুরাইয়া ছিলেন সাধারণ ঘরের একজন নারী। স্বামী, দুই কন্যা ও দুই পুত্রসন্তান নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার। হঠাৎ স্বামীর নজর পড়ে চৌদ্দ বছর বয়সী এক কিশোরীর ওপর। আর তখনই সমস্যাটা শুরু হয়। কিশোরীকে বিয়ে করতে গিয়ে স্ত্রীর নামে বিবাহবহির্ভূত অবৈধ সম্পর্কের গুজব রটিয়ে দেন। এলাকার মাতব্বরদের সঙ্গে নিয়ে সেটা প্রমাণও করেন। নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় সুরাইয়াকে।
হৃদয়বিদারক এই গল্পটি ‘দ্য স্টোনিং অব সুরাইয়া এম’ সিনেমার। গল্পটি ইরানের একটি ছোট্ট গ্রামের। মিথ্যা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নির্মম মৃত্যুর সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। সিনেমাটি ইরান তথা সারা দেশের ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’র প্রতিচ্ছবি হয়ে সেলুলয়েডে ধরা দিয়েছে।
দ্য স্টোনিং অব সুরাইয়া এমের শুরুর দৃশ্যটিও মানুষের ভেতরটা মুষড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ভোরে একজন নারী নদীতীরে গিয়ে একটি কুকুর তাড়ায়। যে কুকুরটি একটি বস্তাবন্দি এবড়ো-খেবড়ো মরদেহের সবটুকুই খেয়ে ফেলেছে। মাটি হাতড়িয়ে নারীটি কয়েকটি হাড় পায়, যা যত্ন করে নদীর পানিতে ধুয়ে নেয়।
মৃত্যুর আগে সুরাইয়া একবার চোখ মেলে তাকিয়েছিলেন। হয়তো সেই তাকানোর মধ্যে শেষবারের মতো বাঁচার আকুতি ছিল। হয়তো সেই চোখ দেখতে চেয়েছিল কেউ তাকে বাঁচাতে আসবে কিংবা শেষ বারের মতো তার দুটি মেয়েকে দেখতে। কিন্তু দেখেছেন তীব্র বেগে ছুটে আসা পাথর।
(দেশ রূপান্তর । ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩)

মন্তব্যসমূহ