দৃষ্টিহীন ছোট ভাইকে বড় বোন বলে ‘তোকে রংধনু দেখাব’
বাবা-মা হারানো এই দুই ভাই-বোন— ছোটু ও পরী থাকে তাদের চাচা-চাচির কাছে। আপনজন বলতে চাচা-চাচি ছাড়া আর কেউ নেই তাদের। চাচা মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখতে নিয়ে যায়। ছোটুর প্রিয় নায়ক সালমান খান আর পরীর শাহরুখ খান। দুই খান নিয়ে তারা প্রায়ই খুনসুটিতে মেতে ওঠে। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছোটু কয়েন টস করে। যে জিতে যায় সে তার প্রিয় নায়কের গল্প শোনায়।
একদিন চাচি পরীকে তাদের সঙ্গে মাঠে গিয়ে কাজ করতে বলে আর ছোটুকে অন্ধদের পড়ার বিশেষ পদ্ধতি ব্রেইল শিখতে বলে। এতে পরী রাজি হয় না। পরী বলে, ওর চোখ ঠিক হয়ে যাবে। ছোটুও রেগে যায়। বলে, তুই চাচি না, চুড়াইল! কিন্তু চাচি নাছোড়বান্দা। ছোটু তার বোনকে বলে, সালমান ভাইকে বলব, চাচিকে একটা ঢুশা মারতে। পরীও বলে, সঙ্গে শাহরুখকেও ডেকে নেব। ছোটু বলে, কেন? পরী জানায়, চাচির জন্য তো দুজনকেই ডাকতে হবে।
এর মধ্যেই সিনেমা দেখতে গিয়ে শাহরুখের ছবিসহ অন্ধকে চক্ষুদানের একটি পোস্টার নজরে আসে পরীর। প্রিয় নায়কই পারবে ছোটুর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে এই ধারণা তার মনে জেঁকে বসে। পোস্টারটি ছিঁড়ে নিয়ে আসে সে। রাতে শাহরুখকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পরী। সে তার খাতায় লেখে প্রিয় শাহরুখ খান স্যার, শুভেচ্ছা নেবেন। আমার নাম পরী। আমার এক ছোট ভাই আছে— ছোটু। সে চোখে দেখে না। আমি ওকে বলেছি বয়স ৯ হলেই চোখে দেখতে পারবে সে। পরদিন চিঠিটি পোস্ট মাস্টারের কাছে নিয়ে দিয়ে বলে, ডাকটিকিটের পয়সা নাই। আপনি দিয়ে দেন। আমি পরে দিয়ে দেব।
ছোটু জন্মান্ধ নয়। চার বছর বয়সে এক অসুখে দৃষ্টিশক্তি হারায় সে। আর দুই মাস পর ৯ বছর হবে তার। বড় বোন পরী তাকে কথা দিয়েছে, ৯ বছর হওয়ার আগেই দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেবে সে। রাতে ছোটুর মাথায় হাত বুলিয়ে পরী বলে, ভাই, আমি তোকে রংধনু দেখাব। ছোটু বলে, রংধনু? সব বাকওয়াস!
একদিন পরী জানতে পারে তার চিঠিগুলো পোস্টমাস্টার শাহরুখের কাছে পাঠায়নি। পরীর খুব মন খারাপ হয়। এদিকে ভাইয়ের জন্মদিনও ঘনিয়ে আসছে। অজানা এক দুশ্চিন্তা ভর করে তার ওপর। ঠিক তখনই সে জানতে পারে পাশের জেলায় শাহরুখ শুটিংয়ের জন্য এসেছে। পরী সিদ্ধান্ত নেয়, ছোট ভাইকে নিয়ে সেখানে যাবে, শাহরুখের সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু তার চাচা বলে শুটিং হচ্ছে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে যাওয়া যাবে না।
পরী হাল ছাড়ে না। রাতে ছোটুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সে আশাবাদী। তার স্বপ্নের নায়ক শাহরুখ ছোটুর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে সাহায্য করবে। একরাশ আশা বুকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে থাকে। তাদের সঙ্গে দেখা হয় ট্রাকচালকের, বাদকদলের, পুলিশের, সন্ন্যাসির, ট্রাভেলারের। অনেকেই তাদের সাহায্য করে। খাবার দেয়, পানি দেয়, চকলেট দেয়। গাড়িতে করে কিছু দূর পৌঁছে দেয়। কেউ বাগড়ে বসে। কেউ অপহরণও করে। কিন্তু বড় বোন পরী ভাইয়ের হাত ছাড়ে না।
এটি একটি সিনেমার গল্প, যার নাম ‘ধানাক’। এর অর্থ রংধনু। জীবন যখন দুঃখ, কষ্ট আর হতাশায় ভরে যায়, তখন রংধনু আশার আলো দেখায়। পরী কিন্তু ঠিকই চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ছোটুকে রংধনু দেখাতে পেরেছিল। ছোটু যখন প্রথম চোখ খোলে, ডাক্তার তাকে বলে কাকে প্রথমে দেখতে চাও তুমি? ছোটু মজা করে বলে সালমানকে। পরীর চোখ তখন টলমল করছে। একটু পরেই ছোটু বলে পরী কি কান্না করছে? পরী তখন হেসে দেয়।
আত্মবিশ্বাসী দৃঢ়চেতা মনোভাব মানুষকে যে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে ধানাক সিনেমায় সেটি দেখানো হয়েছে। মায়ের পরে যার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি আদর পাওয়া যায় সে হচ্ছে বড় বোন। পরীর মতো বড় বোন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। একই সঙ্গে মানবিক সম্পর্কের শ্রেষ্ঠ উপহারও।
(দেশ রূপান্তর । ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩)

মন্তব্যসমূহ